বাংলার উৎসব রচনা [Banglar Utsav Rachana]

বাংলার উৎসব রচনা [Banglar Utsav Rachana]

বাঙালির জীবনে আছে দুঃখ দুর্দশা, অভাব অনটন। নিসফলতা ও হতাশা, কিন্তূ এই বিপরীত ধর্মী শক্তি বাঙালি তথা বাঙালির জীবকে কখনোই স্থগিত রাখতে পারেনি। কারণ বাঙালির জীবনে আছে প্রচুর উৎসব “বাংলার উৎসব” তথা “বড়ো মাসে তেরো পার্বণ। নানান উৎসব সমাহার আসে আর বাঙালির জীবনকে করে তোলে রঙিন আলোই আলোকিত। দূর করে জীবনের গ্লানি। যোগায় কর্মে নতুন উৎসাহ। উৎসব হয়ে ওঠে আমাদের জীবনের চলার পাথেও আর এমনটাই হয়ে আসছে সেই প্রাচীন কাল থেকে। বর্তমানে আমরা যে কত ধরনের উৎসব পালন করি তার সম্পূর্ণ হিসাব করা হয়তো সম্ভব হবেনা । কারণ উৎসবের সূচী এতটাই বড়ো।

বাংলার উৎসব/ উৎসবের তাৎপর্য

বাঙালির উৎসবের মূলে আছে এক অবিচ্ছিন্ন ধর্মবোধ। আড়ম্বর। জাক জমক। বিলাস বাসন বড়ো কথা নয়, কল্যানই বাঙালির উৎসবের প্রধান আদর্শ। “আমার যা কিছু তা সকলের স্পর্শে ধন্য হোক” এই মূল কথা।

উৎসবের বৈচিত্র্য অনুসারে বাঙালির উৎসবকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়:-

  1. ধর্মীয় উৎসব: দূর্গা পূজা, কালি পূজা, সরস্বতী পূজা, জগদ্ধাত্রী পূজা, জন্মাষ্টমী, নীল পূজা। চড়ক, শিব, চতুর্দশী, দোলযাত্রা। রাশ উৎসব ইত্যাদি।
  2. ঋতু উৎসব: নবান্ন, পৌষ পার্বণ, বর্ষা মঙ্গল ইত্যাদি।
  3. সামাজিক উৎসব: বিবাহ, জামাই ষষ্ঠী, রাখি বন্ধন, অন্নপ্রাশন ইত্যাদি।
  4. জাতীয় উৎসব: স্বাধীনতা দিবস, প্রজাতন্ত্র দিবস, রবীন্দ্র জয়ন্তী, গান্ধী জয়ন্তী, নববর্ষ।

ধর্মীয় উৎসব:

হিন্দু ধর্মের উৎসব গুলির মধ্যে সিদ্ধিদাতা গণেশ পূজা দিয়ে আরম্ভ করে তারপর দশহরা, রথ যাত্রা, রাখী পূর্ণিমা, মনসা পূজা, বিশ্বকর্মা পূজা পালিত হয়। এরপর আসে বাঙালির শ্রেষ্ঠ পূজা দূর্গা পূজা। এটি বাঙালির জাতীয় পূজা। এরপর পজাগরি পূর্ণিমায় লক্ষী পূজা, অমাবস্যায় কালি পূজা ও দীপাবলি উৎসব পালন করা হয়। এরপর আসে কার্তিক পূজা, জগদ্ধাত্রী পূজা, মাঘ মাসের সরস্বতী পূজা, বছরের শেষের দিকে অনুষ্ঠিত হয় অন্নপূর্ণা পূজা, বাসন্তী পূজা ও শেষে চড়ক পূজা। তাছাড়াও মুসলমানদের মহরম, ইদ-উল্-ফিতর, সবেবরাত, নবী দিবস ইত্যাদি অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। আবার বুদ্ধ পূর্ণিমা হলো বৌদ্ধদের প্রধান উৎসব। খ্রিস্টানদের বড়দিন, গুড ফ্রাইডে, ইত্যাদি নানা উৎসব পালন করা হয়।

ঋতু উৎসব।

যেমন ঋতু পরিবর্তন হয় তেমনি উৎসবেরও পরিবর্তন হয়। বর্ষা আগমনের সঙ্গে সঙ্গে সুরু হয় বৃক্ষরোপণ উৎসব, এছাড়া বর্ষা মঙ্গল উৎসব। শেষে বর্ষণ উৎসব পালিত হয়। শরৎকালে শারদীয় উৎসব, মাঠের পাকা ধান ঘরে এলে অঘ্রাণ মাসে নতুন ধানের উৎসব তথা নবান্ন উৎসব। পৌষ মাসে পৌষ মেলা, পিঠা পার্বণ। ফাল্গুন মাসে আসে রঙের উৎসব দোলযাত্রা ও হোলি। তারপর চৈত্র মাসে শূন্য প্রান্তরে বছর বিদায় নেয়।

সামাজিক উৎসব:

সারা বছর বাংলার ঘরে ঘরে উৎসব লেগেই থাকে। অন্নপ্রাশন উপনয়ন, বিবাহ, শ্রাদ্ধ শান্তির কাজ, জামাই ষষ্ঠী ভাতৃদ্বিতীয়া ইত্যাদি।

উৎসবের মধ্যে আছে এক প্রাণ শক্তি। তাই মানুষ সৃষ্টি করেছে জন্মগ্রহণে উৎসব, মৃত্যুতে উৎসব। যেনো জীবনের প্রতি পদক্ষেপেই উৎসব বিরাজমান।

জাতীয় উৎসব:

বাঙালির উৎসবের সঙ্গে সঙ্গে তালমিলিয়ে যুক্ত হয়েছে কয়েকটি নতুন উৎসব। এগুলো আবার জাতীয় মর্যাদা লাভ করেছে। ১৫ই আগষ্ট ভারতের স্বাধীনা দিবস, ২৬শে জানুয়ারি প্রজাতন্ত্র দিবস। তাছাড়া পঁচিশে বৈশাখ, ২৩শে জানুয়ারি, গান্ধী জয়ন্তী ইত্যাদি সারা ভারতে পালিত হয়।

অতীত কালের উৎসব:

এক সময় আমাদের উৎসব গুলির মধ্যে ভাবের প্রাধান্য ছিল। আজকের মত আরম্ভর প্রাধান্য ছিল না। পূজা পার্বনে বা পারিবারিক উৎসবে সমাজের মানুষ যোগদান করত এবং কাজকর্ম ও আনন্দ দুই সকলে ভাগকরে নিত। সকলের সমবেত প্রচেষ্টায় উৎসব হয়ে উঠতো সর্বাঙ্গ সুন্দর। উৎসব গুলিতে আর্থিক সংকট ছিল বটে কিন্তু তা উৎসবের আনন্দকে সামান্য স্তবধ করতে পারেনি। তখন দাতা এবং গ্রহীতার দান বিষয়টি ছিল অত্যন্ত স্বাভাবিক।

আধুনিক কালের উৎসব:

বর্তমানে সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের ফলে উৎসবেরও পরিবর্তন হতে চলেছে। এখন ভাবের পরিবর্তে আড়ম্বর প্রধান হয়ে দাঁড়িয়েছে। উৎসবে পাঁচ জন অংশগ্রহণ করুক আমরা আর চাই না। আজকের উৎসব গুলি ব্যক্তি ও পরিবার কেন্দ্রিক হয়ে উঠেছে। নৈতিকথা বর্জিত উৎসব গুলি আজ বড়ই বিশ্রী লাগে। উৎসবের ঐতিহ্যকে বিলীন করে দেয়।

উপসংহার

অবশ্যই আজ আর বাঙালির উৎসবে অতীতকালের সেই গৌরব আর নেই। এমন একদিন ছিল যেদিন উৎসবে ছিল অসীম আনন্দের। কিন্তু বর্তমানে এই ব্যক্তি কেন্দ্রিক উৎসব বাঙালি অতীত গৌরবকে হারিয়েছে। আজ উৎসব শুষ্ক, নিরস, প্রাণহীন। যন্ত্রের যুগে উৎসবে আসে প্রচুর মাইক, বিশেষ বাদ্যযন্ত্র তাতে বাজানো হয় অসংখ্য হিন্দি গান। ঘটা করে মন্ডপ সাজানো হয় এবং আলোকসজ্জিত করা হয়। কিন্তু তাতে সেই প্রাণ নেই শুধুই উৎসবের নামে শুষ্কতা। এখন বাঙালি জাতির কাছে ছাত্র জাতির প্রশ্ন জীবনে সেই পুরোনো দিনের আনন্দ মাধুর্য ভরা উৎসব কি আর ফিরে আসবেনা কখনো?


এই রচনাটি আরো পরিচিত:
  • বাঙালির উৎসব
  • বাঙালির বারোমাসে তেরো পার্বন
  • বাঙ্গালার উৎসবের একাল সেকাল
  • বাঙ্গালার উৎসবের অতীত ও বর্তমান

1 thought on “বাংলার উৎসব রচনা [Banglar Utsav Rachana]”

Leave a Comment