মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের কারণ [Mughal Samrajya Potoner Karon]

মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের কারণ

ভূমিকাঃ-

[Mughal Samrajya Potoner Karon] ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে বাবর মোগল সাম্রাজ্যের যে ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ১৭০৯ খ্রিস্টাব্দে ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর সেই মুঘল সাম্রাজ্য দ্রুত অবনতির দিকে এগিয়ে যায় এবং পরবর্তী ৫০ বছরের মধ্যে মুঘল সম্রাটগণ নামমাত্র শাসকে পরিণত হন।

অবনতির কারণসমূহ

মুঘল সাম্রাজ্যের অবনতির কারণগুলি নিম্নে আলোচনা করা হলো-

মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের কারণ

১/ সাম্রাজ্যের বিশালতাঃ-

মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের একটি অন্যতম কারণ হলো সাম্রাজ্যের বিশালতা। সম্রাট আকবর সাম্রাজ্যবাদী নীতি গ্রহণ করে মুঘল সাম্রাজ্যের সীমানা বহু দূর পর্যন্ত বিস্তৃত করেছিলেন এবং মোগল সাম্রাজ্যের সুযোগ্য উত্তরাধিকার হিসাবে সম্রাট ঔরঙ্গজেব তার পুনরাবৃত্তি করেছিলেন।ঔরঙ্গজেবের শাসনের আগে ভারতের ইতিহাসে আর এত বড় সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা হয়নি।সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে অশান্তির সৃষ্টি হলেএই বিশাল সাম্রাজ্যের রাজধানী দিল্লি থেকে দূরবর্তী জায়গাগুলিতে সময়মতো পৌঁছানো সম্ভব হতোনা। যে কারণে এত বড় সাম্রাজ্যকে দুর্নীতিমুক্ত রাখা যথেষ্ট কষ্টসাধ্য ছিল আর ঠিক সে কারণে মুঘল সাম্রাজ্যের পতন ঘনিয়ে আসে।

২/ ঔরঙ্গজেবের পরবর্তী মুঘল সম্রাটদের অযোগ্যতাঃ-

সম্রাটের দক্ষতার উপর মুঘল সাম্রাজ্যের সাফল্য নির্ভরশীল ছিল।সম্রাট জাহাঙ্গীর ও শাহজাহানের সময় থেকে মুঘল শাসন কাঠামোর মধ্যে ঘোর সমস্যা দেখা দিয়েছিল। ঔরঙ্গজেবের শেষ দিকে তা আরো সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। ঔরঙ্গজেবের পরবর্তী সম্রাটদের অযোগ্যতার জন্য মুঘল সাম্রাজ্যের দ্রুত অবনতি হয়েছিল।

৩/ সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট উত্তরাধিকারী আইনের অভাবঃ-

মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের আরো একটি অন্যতম কারণ হলো সুস্পষ্ট উত্তরাধিকারী আইনের অভাব। ঔরঙ্গজেব নিজে তার ভাইদের সাথে উত্তরাধিকার দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে পড়েছিলেন। ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পরে এই বিষয়টি ব্যাপক আকার ধারণ করে। এই ধরনের উত্তরাধিকার সংক্রান্ত সংঘাত যা সাম্রাজ্যের স্থিতিশীলতাকে নষ্ট করে দিয়েছিলো।

৪/ সামরিক দুর্বলতাঃ-

মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের জন্য আরো একটি অন্যতম কারণ হলো সামরিক দুর্বলতা। বস্তুত মুঘল সেনাবাহিনীর কখনই সম্রাটের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে ছিল না সেনাবাহিনীর দায়িত্বে থাকতেন মনসবদারেরা। মনসবদারেরা ঔরঙ্গজেবের আমলে প্রায় সবাই আবার জায়গিরের দায়িত্বেও ছিলেন।এই সময় একদিকে মনসবদারের সংখ্যা যেমন বাড়ছিল তেমনি অন্যদিকে তারা ভালো জায়গির পাওয়ার প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছিল। ঠিক এই পরিস্থিতি থেকেই সৃষ্টি হয় জায়গির সংকট।এই সংকট ক্রমশ প্রবল আকার ধারণ করে।এছাড়াও ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর সেনাবাহিনী দুর্বল হয়ে পড়লে সাম্রাজ্যের পতন অনিবার্য হয়ে পড়ে।

৫/ অর্থনৈতিক সংকটঃ-

দুর্বল অর্থনীতি,অনাবশ্যক ও হিসাবী অর্থব্যয় এবং আয় বৃদ্ধির প্রচেষ্টার অভাব মুঘল সাম্রাজ্যের অস্তিত্বের পক্ষে ক্ষতিকারক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। অহেতুক যুদ্ধ, মোঘল দরবারে সম্রাটদের বিলাসবহুল জীবনযাপন ইত্যাদি কারনে খরচ ক্রমশই বাড়ছিল কিন্তু আয় সেভাবে বাড়েনি। কৃষি শিল্প বা ব্যবসা-বাণিজ্যের তেমন সম্প্রসারণও হয়নি। এক কথায় সবমিলিয়ে মুঘল অর্থনীতি চরম সংকটের মধ্যে পড়েছিল যা মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের একটি অন্যতম কারণ ছিল।

৬/ কৃষক বিদ্রোহঃ-

মোগল সাম্রাজ্যের পতনের কারণগুলির মধ্যে আরও একটি অন্যতম কারণ হলো কৃষক বিদ্রোহ। মুঘল আমলের শেষ দিকে কৃষক অ সন্তোষ ও বিদ্রোহ ছিল একটি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। জায়গীর হস্তান্তর, জায়গীর সংকট ব্যাপকভাবে কৃষকদের প্রভাবিত করেছিল। জায়গির ও মনসবদারেরা ক্রমশ কৃষকদের শোষণ করতে শুরু করেন এছাড়া ইজারা প্রথা প্রবর্তনের ফলে কৃষকদের ওপর অত্যাচারের মাত্রা বেড়ে যায় ফলে তৈরি হয় কৃষক বিদ্রোহ যা মুঘল সাম্রাজ্যের ভীত কাঁপিয়ে দিয়েছিল।

৭/ ঔরঙ্গজেবের ভ্রান্তনীতিঃ-

মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের জন্য ঔরঙ্গজেবের ভ্রান্তনীতি ছিল অন্যতম।তাই তার ভ্রান্ত দাক্ষিণাত্য নীতি,রাজপুত নীতি, জিজিয়া কর আরোপ ইত্যাদি রাজনীতি,অর্থনীতি ও জনজীবনে এক বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে যা মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের পথ প্রশস্ত করে দেয়।

৮/ বৈদেশিক আক্রমণঃ-

মুঘল সম্রাটদের দুর্বলতার সুযোগে বৈদেশিক আক্রমণের প্রভাব ক্রমশই বৃদ্ধি পায়। অবশেষে ১৭৩৯ খ্রিস্টাব্দে নাদির শাহ এবং ১৭৪৮ ও ১৭৬১ খ্রিস্টাব্দে আহমদ শাহ আবদালির ভারত আক্রমণ মোগল সাম্রাজ্যের পতনকে সুনিশ্চিত করে তুলেছিল। অবশেষে ইংরেজদের দ্বারা এই সাম্রাজ্যের শেষ প্রদীপের শিখাটুকুও নিভে যায় এবং মুঘল সাম্রাজ্যের পতন সুনিশ্চিত হয়ে পড়ে।

৯/ শিবাজী ও মারাঠাদের আক্রমণঃ-

শিবাজী ও মারাঠাদের আক্রমণ মুঘল শাসনকে তছনছ করে দিয়েছিল।ঔরঙ্গজেব মারাঠাদের দমন করার জন্য তার জীবনের শেষ ২৬ টি বছর দাক্ষিণাত্যে কাটিয়েছিলেন কিন্তু তাতেও সাফল্য পাননি শেষ পর্যন্ত নেমে এসেছিল এই বিরাট মুঘল সাম্রাজ্যের পতন।

মূল্যায়নঃ-

উত্থান পতন প্রকৃতির নিয়ম হলেও মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের ক্ষেত্রে উল্লেখিত কারণগুলি দায়ী ছিল এছাড়াও জাতীয়তাবাদের অভাব, আর্থসামাজিক পরিস্থিতির পরিবর্তন,রাজনীতিতে গভীর প্রভাব বিস্তার করে। যোগ্য কর্মচারী বা আমলা শ্রেণীর দক্ষতা দেখা যায়নি।ফলে এই বিশাল মুঘল সাম্রাজ্য অবক্ষয়ের পথে দ্রুত এগিয়ে যায় এবং নেমে আসে ঘোর অন্ধকার।বিলীন হয়ে যায় বাবরের প্রতিষ্ঠিত এই বিশাল সাম্রাজ্য।

Leave a Comment